৯ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার, বিকাল ৩:০১

যেকোন কাজ করতে রাজী তারা…

প্রাইমনারায়ণগঞ্জ.কম

নগরীর ২নং রেল গেইট ও সনাতন পাল লেনের ফুটপাতে ভোর থেকে বসে বিপুল মানুষের মেলা। জড়ো হওয়া মানুষের কারো কাঁধে কোদাল, কারো হাতে কাস্তে। কেউ আবার ভবন ঢালাইয়ের টুকরি নিয়ে শামিল হচ্ছেন জমায়েতে। কারো কাঁধে গামছা, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে কয়েকজনের মাথায় দেখা যায় মাথালও। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে জড়ো হন অন্তত শ’খানেক মানুষ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, শ্রমিকদের মিলনমেলা। চাতক পাখির মতো এই শ্রমিকরা কিছু একটা খুঁজছেন।

পাশে গিয়ে জানা গেল, এই মানুষগুলো তাঁদের শ্রম বিক্রি করতে সেখানে জড়ো হয়েছেন। চাতক পাখির মতো তাঁরা খুঁজছেন কেউ যদি তাঁদের শ্রম কিনতে আসেন।

জটলার কাছে পৌঁছানোর আগেই ছুটে আসেন এক যুবক। তাঁর নাম বিল্লাল। তিনি বললেন, ‘স্যার, মানুষ লাগব? কয়জন নিবেন? আমরা সব কাম করতে পারি। বালু উঠানো, অফিস পাল্টানো, সব কাম।’

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা থেকে কাজের খোঁজে নারায়ণঞ্জে আসা বিল্লাল এর আগে একটি প্রাইভেট কম্পানির কাভার্ড ভ্যানের চালক ছিলেন। করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অঘোষিত লকডাউনে তাঁর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে ফিরে যান তাড়াশে। সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটি শেষে কাজ শুরু হলে কর্মস্থলে ফিরে শোনেন যে তাঁর চাকরি নেই। অন্য কয়েক জায়গায় কাজ পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। শেষে দুই মুঠো খাবার জোটাতে নাম লেখান ভাসমান শ্রমিকের খাতায়। প্রাইম নারায়ণগঞ্জকে বিল্লাল বলেন, ‘ড্রাইভারির চাকরি হারাইয়া এক মাস ধইরা এহানে আছি। এই এক মাসে কাজ পাইছি মাত্র তিন দিন। আয় হইছে মাত্র এক হাজার ২৫০ টাকা। এই আয় দিয়া ক্যামনে চলি!’

বিল্লালের মতো প্রতিদিন ভোরে অনেকেই এখানে জড়ো হন ২নং রেল গেইট ও সনাতন পাল লেনের ফুটপাতে, তাঁদের সবাই ভাসমান শ্রমিক। দৈনিক চুক্তিতে কাজের খোঁজে সেখানে জড়ো হন তাঁরা। ভোর সাড়ে ৬টা থেকে সকাল ১০/১১টা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন তাঁরা। দুইজন থেকে শুরু করে ৫ জন পর্যন্ত ছোট ছোট দলে চলে অপেক্ষার পালা। এই জমায়েতে পুরুষ শ্রমিকের পাশাপাশি কাজের সন্ধানে আসেন কিছু নারী শ্রমিকরাও।

তাঁরা রান্নাবান্না, ইট, বালু, সিমেন্ট ওঠানো-নামানো, টাইলস পরিষ্কার, ভবন ঢালাই, বাসা ধোয়ামোছা, রাজমিস্ত্রির সহযোগী, মাটি কাটা, ইট পরিষ্কার ও ভাঙানো, টাইলস পুডিং পর্যায়ের সব কাজ করেন।

ভিড় থেকে পছন্দ অনুযায়ী শ্রমিক বাছাই করে চুক্তিভিত্তিক কাজে নিয়ে যান। একজন থেকে শুরু করে ১০/১৫ জন পর্যন্ত শ্রমিকও নেন কেউ কেউ। দৈনিক ভিত্তিতে এসব শ্রমিকের মজুরি ভিন্ন ভিন্ন। তবে তাদের গড় মজুরি ধরা হয় ৫০০ টাকা। প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসে চুক্তি করে শ্রমিকদের নিয়ে যায়। কখনো কখনো প্রায় সব শ্রমিকের দৈনিক এই কাজ জোটে।

২নং রেল গেইটে কিশোরগঞ্জের ইটনা থেকে আসা শ্রমিক রোমান প্রাইম নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘করোনার আগে দিনে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার চুক্তিতে কাম করতাম। তহন সপ্তাহের প্রতিদিন কাজ পাইতাম। মাঝে দু/তিন মাস কাজ-কাম ছিলো না, তয় এহন কিছু কাম পাই। তয় এহন এক দিন কাজ কইরা পাই ৪০০ টাকা। সংসার চালাইতে অনেক কষ্ট হইতাছে।’

রোমানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন পাশের শ্রমিকরাও এগিয়ে আসেন। বলতে থাকেন নিজেদের কষ্টের কথা। জাহাঙ্গীর নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আপনারা (গণমাধ্যমকর্মীরা) তো সবার দুঃখ-কষ্ট নিয়া লেখেন, আমাদের কষ্টের কথাও একটু তুইলা ধইরেন, স্যার। আমরা গরিব মানুষ, কাজকাম পাই না, পরিবার নিয়া ক্যামনে বাঁচুম!’

এ সময় এক নারী শ্রমিক বললেন, ‘আমি আগে বাসায় রান্নার কাম করতাম। করোনার জন্য হেরা বাসা ছাইড়া দেশে গেছে গা। অনেক চেষ্টা কইরাও আর কাজ না পাইয়া এইহানে আইছি। আপনের বাসায় বুয়া লাগলে আমারে কাজ দেন।’

শ্রমিকদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন পাশেই একটা জটলা তৈরি হয়। দেওভোগের সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি ইট ও বালু পরিবহনের জন্য দুজন শ্রমিক খুঁজছেন। তিনি প্রাইম নারায়ণগঞ্জকে বলেন, ‘বাসায় কিছু কাজ করাতে হবে। এ জন্য ইট ও বালু আনব। দুজন শ্রমিক দরকার।’ পরে দেখা গেল, ৫০০ টাকা জনপ্রতি হিসাবে দুজন শ্রমিক নিয়ে গেছেন তিনি। আর সেদিকে চেয়ে থাকল শ্রমিকদের ২০-২৫ জোড়া চোখ।

বাছাইকৃত সংবাদ

No posts found.